ডলার বিড়ম্বনা

বয়স ব্যাপারটা কমে না। বরং বেড়ে যায় আর বেড়ে যায় পরিবারে দায়িত্ব আমাদের উপরে। রাস্তার পাশে অনেক ব্যানার থাকে, চলতে চলতে চোখ পড়ে যায়। আবার ইদানিং কোভিড-১৯ এর কারনে অনলাইনেও কমতি নেই এইসব কিছুর। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম “ ঘরে বসে আয় করুন ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা সহজেই ” আমাদের মতো ছেলে মেয়ে যারা টিউশন করে জুতোর বেহাল করে ফেলে তাদের জন্য ঘরে বসে কাজ করা এবং আয় করা যেন সোনায় সোহাগা ব্যাপার।

তাই আর নাহ দেখে সেই লোককে মেসেজ করে জানলাম কাজ কি। সে বলল আমাকে তাকে প্রথমে ১ হাজার টাকা দিতে হবে যাতে আমি কাজ ছেড়ে না যাই, এক প্রকারের সিকিউরিটি মানি। দিয়ে দিলাম তাকে আমার আগের মাসের টিউশনের বেতন থেকে। কিন্তু তারপর দেখলাম সে দিল আমাকে ফেসবুকে ব্লক। এখন তাকে হাজারো খুজে পাওয়া আমার কাছে অসাধ্যের মতো ব্যাপার। হাল ছেড়ে, তাকে কিছু খারাপ কথা মনে মনে বলে ফেসবুকে ব্রাউজ করতে থাকলাম। এবার এলো এক অনলাইন প্রতিষ্টানের নাম। ১০ হাজার টাকাতে ফ্রিল্যান্সিং শিখাবে তা দিয়ে আমি মাসে হাজার হাজার ডলার আয় করবো।

যাইহোক আমাদের মতো পরিবারের ছেলেদের জন্য ১০ হাজার টাকা একেবারে দেয়া হলো এক মাসের বাড়ি ভাড়া দেয়া। তারপরে বাসায় যে ল্যাপটপ আছে তা যায় যায় অবস্থা। তাও ভাবলাম কিভাবে কি করবো, টিউশনের টাকায় তো আর চলছে না।
রিয়াদের মতো হাজার ছেলে-মেয়ের চোখে সাবলম্বি হবার স্বপ্ন। কারো নিজের জন্য, কারো পরিবারের জন্য, কারো আবার সমাজের কাছে নিজেকে যোগ্য করে তোলার জন্য। সেখানে ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে এমন এক জগত যা মানুষের জীবনে ইউরোপের মতো। যেতে পারুক না পারুক , যাওয়ার ইচ্ছে আছে।

রিয়াদ ভাবলো কি করা যায় এইবার?

সে ফেসবুকে এক ফেমাস ফ্রিল্যান্সারকে ফলো করতো, তাকে মেসেজ দিয়ে দেখলো কিন্তু সে এক মাসেও তার মেসেজ দেখলো না। একদিন সে ভাবলো না থাক আমি নিজেই খুজে বের করব কিভাবে কি করা যায়। এখন যতো উৎসাহ নিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসে গেল , ততো উৎসাহ তার টুস করে ফুটে গেল এই ভেবে শুরু কি করে করবে? যাইহোক গুগল খুলে সার্চ করল ফ্রিল্যান্সিং কি? কিভাবে করে?

গুগুলে চলে এলো যতো ফেইক সাইট, এক সপ্তাহে আয় করুন লাখ লাখ টাকা ফ্রিল্যান্সিং এ, ৪ – ৫ টা ভিডিও দেখে সে পাগল হয়ে গেল, বললো – ভাই, মানুষ কেন এইগুলো করে? আরেকজনকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়?

গুগুল থেকে যা জানতে পারলো তাতে সে বুঝলো ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে বাহিরের দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কিছু স্কিল দিয়ে কাজ করে আয় করাকে বোঝায়। এবং অনেক কিছু নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করা যায় – হতে পারে তা গ্রাফিক ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি কিনবা ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি।
রিয়াদ ভাবলো সে কি করে বুঝবে কোনটা তার জন্য ভালো হবে। রিয়াদ পড়ছে ইংরেজি সাহিত্যে এবং রিয়াদের তেমন বেসিক কম্পিউটার বাদে আর কোন স্কিল নেই। তাই সে ভাবলো কি করবো আমি? ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে ফেলি তাহলে অনেক টাকা হবে, ডলার হবে। শুরু হয়ে গেল তার শেখা। দশ হাজার টাকা দিয়ে কোর্সের শুরু।

ফেসবুক মার্কেটিং থেকে শুরু করে সব কিছুই ভালো লাগছে কিন্তু বাঁধা পড়ল তখন যখন সে জানতে পারলো, ফেসবুক মার্কেটিং বা যেকোন মার্কেটিং এ গ্রোথ আসতে দেরি হয়। তাহলে সে কিভাবে কম সময়ে আয় করবে বলুন? উফ! আমাদের সমাজের ছেলে-মেয়েরা না সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মতো, টেইলার্স খুলে গার্মেন্টস কোম্পানির মালিক হতে চায় তাও সহজেই।

সবাইতো আর শাবনূর হয় না। আর এইজন্য ফ্রিল্যান্সিং এ যদি প্যাশন না থাকে ভালো ভাবে কোন স্কিল শিখবেন সেটা না নিয়ে রিসার্চ করেন তাহলে, আপাদমস্তক ঘোলা জল খেতে হবে। তাই আপনি যে বিষয়ে পড়ালেখা করছেন, আপনার যা ভালো লাগে, যা শিখতে আপনার বোরিং লাগবে না এক কথায় চেষ্টা থাকবে, তাই শিখুন।

রিয়াদ ভাবলো – ১০ হাজার টাকা জলে গেল এইবার সে কি করবে? ডলারতো হলো না। তাও একটা মার্কেটপ্লেসে প্রোফাইল করে দেখি। কোথায় করা যায়? আপওয়ার্ক নাকি ফাইভার? আপওয়ার্কেই করে দেখি , তাহলে ভালো হবে। তারপর সে একখানা প্রোফাইল করে কাজে এপ্লাই করতে শুরু করলো। কিন্তু সারাদিন এপ্লাই করে কাজের কোন নাম নেই। এক সপ্তাহ গেল, এক মাস গেল। রিয়াদ তো ফ্রিল্যান্সিংকে গালি দিতেই শুরু করে দিল।

সকাল সকাল চা খেতে খেতে আবার রিয়াদের ফেসবুক দেখার স্বভাব। হঠাত দেখলো একলোক বলছে তার কোর্স করে আপওয়ার্কে কাজ পাওয়া যাবে। কোর্সের দাম ৬০০ টাকা। দিব কি দিব নাহ? আচ্ছা এতো টাকা গেল আরেকটা কোর্স করতে কি? সে কোর্স নিয়ে দেখা শুরু করলো। দেখা শেষ! এইবার আপওয়ার্কে গিয়ে কানেক্ট কিনে আবার শুরু করলো সেখানে তার ১৫০০ চলে গেল। কিন্তু কাজ পেল না।

এইবার রিয়াদ ভাবলো এর থেকে সে যদি কোন দোকানে চাকুরি করতো তাও তার এতো টাকা যেত না যতো ফ্রিল্যান্সিং শিখতে গিয়ে গেল।
রিয়াদের মতো হাজারো ছেলে মেয়ে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং এর ভুল-ভুলাইয়াতে আসে ডলার আয় করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু কথায় আছে না, আপনি এভারেস্টে উঠার আগে যদি না জানেন, উচ্চতায় গিয়ে আপনার অক্সিজেনের লেভেল কমে যাবে তাহলে তো আপনি প্রান নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন না। ঠিক তেমনি আমাদের ছেলে মেয়েরা ডলারের চিন্তায় রাতের যতো ঘুম হারাম করে রেখেছে তা যদি তারা দক্ষতায় দিত তাহলে তারা হয়ত সব জায়গায় সাফল্যের মুখ দেখতো।

ভাবুন রিয়াদের মতো ছেলে মেয়েরা যদি ফ্রিল্যান্সিং প্লাটফর্মে ঝাঁপিয়ে না পরে ২ মাস সময় দিয়ে নিজের ভালো প্রোটফলিও বানাতো, ইংরেজিতে দক্ষ হতো তাহলে তাদের ফ্রিল্যান্সিং কে গালি দিতে হতো না। এমনতো না এইখানে কেউ সফল হয় নি? হয়েছে! কিন্তু আপনি হন নি কারন আপনি ডলারের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, এবং এমন মানুষের পিছনে ঘুরেন যে হাজার হাজার ডলার আয় করে। কিন্তু দক্ষতার পিছনে আপনি কবে ঘুরেছেন?

আমার মা বলে আমাকে, যদি জীবনে বড় হতে হয় তাহলে টাকার চিন্তা মাথা থেকে ফেলে তারপর কাজ করে যেতে, কাজ করলে তার পারিশ্রমিক আসবে এইটা তো জানা কথা। তাহলে পারিশ্রমিকের চিন্তায় কেন আমরা কাজ শেখার পিছনে সময় দিব না। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ছেলে মেয়েদের স্বপ্ন বেশি, সাথে আমাদের হাতে সময়ও আছে। এখন যদি সেই সময় থেকে একটু সময় দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শিখলে আমাদের হাজার হাজার টাকা বেঁচে যায় তবে , সেই তো ভালো পথ।

তাহলে আর কেন ডলার বিড়ম্বনা , বলুন?

জয়িতা ব্যানার্জি, সিইও, টকস্টোরি

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।