“মনের ডাক্তার” মুরাদ আনসারীর সাথে আলাপ

“ধ্যান জ্ঞান সবকিছু ঘিরেই ছিলো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন, মেডিকেল ছাড়া অন্য কোথাও ভর্তি পরীক্ষাও দেইনি, কিন্ত যখন মেডিকেলে চান্স পেলাম না তখন সারা পৃথিবী যেন বদলে যেতে শুরু করল। একরকম হতাশায় ডুবে গেলাম, পরে বড় মামির অনেক জোড়াজুড়িতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া। তারপর চান্স পাওয়া এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ভর্তি হওয়া, তবে হ্যা, এরপর থেকে আর ডাক্তার হতে না পারার আফসোস ছিলোনা”

– এভাবেই মুরাদ আনসারী কন্টেন্ট রাইটার সুমাইয়া জামান মিমের কাছে টকস্টোরির আড্ডায় নিজের জীবনের উত্থান-পতনের গল্প বলছিলেন।

আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন আপনি?
মুরাদঃ আলহামদুলিল্লাহ! আসলে এই সময়টাতে যতটুকু ভাল থাকা যায়, ততটুকু ভাল থাকার চেষ্টা করছি।

আপনার শৈশব কিভাবে কেটেছে?
মুরাদঃ আমি জামালপুরের ছেলে, জন্ম, বেড়েওঠা সব সেখানেই। ছোটোবেলা পরিবারকে সেভাবে সময় দেয়া হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার জন্য ছোট থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি, তবে হাসিল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে আমি এসএসসি শেষ করি আর সরকারী আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচ এসসি শেষ করি।

ছোটোবেলায় কি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
মুরাদঃ খুব ছোটোবেলা কেডি পাঠকের মত উকিল হওযার স্বপ্ন দেখতাম, “ল” নিয়ে পড়ার প্রতি প্রচুর আকর্ষণ ছিলো, কিন্ত যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন লক্ষ চেন্জ করে ডাক্তার হওয়ায় মননিবেশ করি এবং তখন থেকেই মেডিকেলে পড়বো এই স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকি।

বর্তমানে কোথায় পড়ছেন ?
মুরাদঃ বর্তমানে তো বন্দীদশায় আছি, হাহা। বর্তমানে পড়াশোনা করছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্লিনিকাল সাইকোলজি নিয়ে। পাশাপাশি সাইকিউর নামের একটা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি।

মেডিকেল থেকে সাইকোলজিতে ডায়ভার্ট হবার গল্পটা যদি একটু বলতেন?
মুরাদঃ একটু ডিটেইলস এই বলি, আমার ধ্যানজ্ঞান সবকিছু ঘিরেই ছিলো মেডিকেল, স্বপ্ন ছিলো একটাই ডাক্তার হওয়ার, ভর্তি পরীক্ষায় মেডিকেল ছাড়া অন্য কোথাও পরীক্ষাও দেইনি। কিন্ত যখন চান্স হলোনা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। একপ্রকার বড় মামির জোড়াজুড়িতে রাবিতে পরীক্ষা দিতে যাই, চান্স ও পেয়ে যাই বায়োলজি ইউনিটে, কিন্ত আমার মনে শুধুই মেডিকেল তাই সাবজেক্টও আমি পছন্দ করিনি, আমার ভাইয়া সাবজেক্ট সিলেক্ট করে দেয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, কারণ এটা তখন রাবির নতুন ডিপার্টমেন্ট হিসেবে খোলা হয়েছিলো।

আমার সিরিয়াল সামনের দিকে ছিলো, এটা নিয়ে পড়লে ফ্যাকাল্টি হবার চান্সও ছিলো তাই ভাইয়া এই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে আমি আমার ডিপার্টমেন্টের নামটাও ঠিকমত জানতাম না, আমি ভেবেছিলাম ক্রিমিনাল সাইকোলজি পড়বো, ক্রিমিনালদের নিয়ে কাজ করব। পরে ক্লাস শুরু হবার পর আস্তে আস্তে নিজেকে বুঝতে পারি, নিজের সাবজেক্টকে বুঝতে পারি, এখন অবশ্য ডাক্তার না হতে পারার কোনো আফসোস নেই, বরং নিজেকে “মনের ডাক্তার” হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

সাইকিউর এর চিন্তা কিভাবে মাথায় এলো, কি ভেবে এ উদ্যোগটা নেয়া হলো?
মুরাদঃ আচ্ছা, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করার পর এই সাবজেক্টের ক্যারিয়ার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতাম, দেখতাম আমাদের সমাজে এই মূল্যবান সাবজেক্টটার মূল্য নেই বললেই চলে। শারীরিক সমস্যাকে আমরা যতটা গুরুত্ব দেই, মনের সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবিও না, বরং মানসিক সমস্যা একধরণের ট্যাবু আমাদের কাছে। তারপর একদিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. মাহবুবুর রহমানের স্যারের একটা লেখা পড়লাম, সাইকোলজিতে লেখাপড়া করে মাত্র ২ % স্টুডেন্ট জব অপরচুনিটি পাচ্ছে ।

তখন মনে হলো এই সেক্টর নিয়ে প্রচুর কাজ করার সুযোগ আছে। তার পর কাজে, মার্কেট এনালাইসিস, নেটওয়ার্কিং এবং মাঠে নামা। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে BYLC নামক অর্গানাইজেশনটি। যদিও রাবির হাইয়ার স্টাডি ক্লাবের অবদানও কম নয়, হাইয়ার স্টাডি ক্লাব থেকেই মূলত BYLC এর সাথে কাজ করার সুযোগ পাই, তাদের একজন গ্রাজুয়েট হওয়ার সুযোগ পাই, BYLC মূলত আমার সবধরণের কাজের অনুপ্রেরণা।

একদম শুরুর দিকের গল্পগুলো শুনতে চাচ্ছি।
মুরাদঃ শুরুতে এত বড় প্লাটফর্ম হবে সেটা কখনো ভাবিনি, ইচ্ছে ছিলো ছোট করে ভার্সিটির অন্য ক্লাবের মত করে কাজ শুরু করবো। তবে সেভাবে কোনো সাড়া পাইনি। প্রথমদিকে খুবই স্ট্রাগল করতে হয়েছে, শুরুতে যাদের নিয়ে ছোট করে কাজ শুরু করেছিলাম কিছুদিন পর থেকে আর তাদের সাথে মতের মিল হচ্ছিলো না, কো ফাউন্ডার/এক্সিকিউটিভদের মধ্যে তাদের ডেজিগনেশন নিয়ে সমস্যা হচ্ছিলো, একসময় অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সবাই বলে আমরা এটাকে একবছরও রান করাতে পারবোনা।

তবে আমি হাল ছাড়িনি, চেষ্টা আর কাজ চালিয়ে গিয়েছি, তবে BYLC এর প্রতি খুব বেশি কৃতজ্ঞ আমি, আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে তারা, তাদের সহযোগিতায় এতদূর আশা। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতেই সাইকিউরের কার্যক্রম শুরু করি আমরা, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করি ২০১৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি থেকে।

সাইকিউর নাম দেয়ার কারণ?
মুরাদঃ সাইকলোজি থেকে আসলে সাইকিউর নামটার আইডিয়া মাথায় আসে। সাইকোলজিকাল সবধরণের সাপোর্ট দেয়ার জন্যই আসলে আমাদের লক্ষ্য এবং সাইকিউর নামটা দেওয়া।

আপনারা কিভাবে কাজ করছেন?
মুরাদঃ আমরা বিভিন্ন অর্গানাইজেশন, প্রতিষ্ঠানকে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং- এর ট্রেনিং দিয়ে থাকি, আমরা এখন মূলত এওয়ারনেস নিয়ে কাজ করছি, প্রায় ত্রিশহাজার মানুষকে আমরা এই পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়েছি এবং ফেসবুক লাইভ চ্যাটের মাধ্যমে গত নয় মাস ধরে প্রায় ১৪০০ মানুষকে মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট দিয়েছি। এছাড়া আমরা বিভিন্ন ধরণের ক্যাম্পেইন করে থাকি। বিভিন্ন ক্যাম্পাস ভিত্তিক প্রোগ্রাম করেছি, ইএমকে সেন্টারেও প্রোগ্রাম করেছি। এবারের বইমেলায় কয়েকজন সাইকোলজিস্টদের লিখা নিয়ে “মনো জগতের আঁধার আলো”নামে একটা বই প্রকাশ করেছি।

বর্তমানে কি করছেন আপনারা?
মুরাদঃ বর্তমানে ন্যাশনাল মাদারস ক্যাম্পেইন – “মায়ের সাথে, মায়ের পাশে” নিয়ে কাজ করছি। এই আইডিয়াটা মাথায় আসে মূলত এই কোভিডের সময়টাতেই। এই সময়ে আমাদের থেকে মায়েদের কাজের এবং মেন্টাল প্রেসার অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কখনো তাদেরকে নিয়ে ভাবাই হয়না, তাই আসলে চট করে উদ্যোগটা নেয়া। মনে হলো যে মানুষটা আমাদের জন্য এতকিছু করছে এই সময়টাতে সেই মাকে নিয়ে কিছু করে ফেলা যাক। এই উদ্যোগটা অনেক বেশি সাড়া ফেলে, প্রায় ৮ টা কোম্পানি/অর্গানাইজেশন আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছে, প্রায় বিশটা ক্যাম্পাসের ২৫টা ক্লাব আমাদের সাথে এই ক্যাম্পেইনে কাজ করছে, নতুন নতুন অনেক আইডিয়া পাচ্ছি, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা বিষয়।

কাজ করতে গিয়ে কি কি শিখছেন প্রতিনিয়ত?
মুরাদঃ খুবই ভালো প্রশ্ন, আমি আসলেই প্রতিনিয়ত শিখছি, নতুন নতুন স্কিল গেদার করছি। সফটস্কিলগুলো ডেভেলপ করছি। আমি আসলে হাতে-কলমের শেখায় বিশ্বাসী, সাইকিউরের সাথে কাজ করতে গিয়ে সাইকোলজির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শিখছি, বিষয়গুলো খুবই উপভোগ্য। পাশাপাশি একই সাথে একটা প্রতিষ্ঠান কিভাবে চালাতে হয়, কি কি দক্ষতা লাগে সেগুলোও শেখা হচ্ছে।

আপনার অনুপ্রেরণা কে? কার মাধ্যমে আপনি অনুপ্রাণিত হন
মুরাদঃ আমার সবটা জুড়েই BYLC এর অবদান, তাদের প্রোগ্রাম আর ট্রেনিং গুলো এটেন্ড করার পর থেকে নতুন নতুন জিনিস শিখতে থাকি। তবে ইয়ুথ অপরচুনিটির প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন নুর ভাইয়া আমার একজন ইন্সপায়ারেশন, তার সব কাজগুলো আমাকে নতুন কিছু শেখায়।

সাইকিউর এর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
মুরাদঃ ২০২৬ সালের মধ্যে সাইকোলজি ফিল্ডে কর্মক্ষেত্রের রেশিউটা ২ পার্সেন্ট থেকে ২৫ পার্সেন্টে নিয়ে যেতে চাই। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে চাই এই সেক্টরে। ২০২৬ সালে কাজগুলো দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাই এবং ২০৪০ সালে সমগ্র বিশ্বে একটা সাইকোলজিক্যাল বিপ্লব ঘটাতে চাই। সাইকোলজিক্যাল লিটারেচার, বেশি বেশি স্কিলফুল মেন্টাল হেল্থ এক্সপার্ট তৈরী করে এবং সার্ভিস ব্যবস্থার উন্নতি করে সাইকোলজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি করতে চাই।

আর নিজেকে নিয়ে কি পরিকল্পনা করছেন?
মুরাদঃ আপাতত নিজেকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি, সাইকিউরকে ঘিরেই সব ধ্যান ধারণা, কারণ সাইকিউর প্রতিষ্ঠিত হলে আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে। তবে, আমার গ্রাজুয়েশন শেষে একজন বিজনেস সাইকেলজিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করব এবং ইচ্ছে আছে লেখালিখি করার।

অসংখ্য ধন্যবাদ, মুরাদ। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো
মুরাদঃ আপনাকেও ধন্যবাদ আপু, সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।

 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সুমাইয়া জামান মিম

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।