নারী উদ্যোক্তা কথন

বিশ্বের অর্ধেক জনসংখা যেখানে নারী সেখানে নারীকে বাদ দিয়ে এই পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি পুরোপুরি সত্য। তবে অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ সবসময়েই কম। তবে আশার কথা এই যে, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান দিন দিন বাড়ছে। আজ নারী ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে, নানা প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালেই।

নারী আজ শুধু চাকরিই নয়, উদ্যোগী হচ্ছে নানা স্বাধীন ব্যবসায়। বর্তমানে নারীরা পরিবার ছাড়াও দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছেন। তাদের একনিষ্ট প্রচেষ্টায় অর্থনীতির চাকা দিন দিন আরও বেশি সচল হচ্ছে। বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে প্রশংসিতভাবে।গত কয়েক বছর ধরেই সামগ্রিক অর্থনীতিতে নারীর অবদান ঊর্ধ্বমুখী। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও যে কাজগুলো শুধু ছেলেদের দ্বারাই করা সম্ভব বলে মনে করা হতো এমন কাজগুলো আজ নারীরা সফলভাবে করছেন।

এছাড়া সামাজিক সংগঠনগুলো যদি ইতিবাচক উদ্যোগ নেয় তবে সমাজ, অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে।আজ আমি হাজির হয়েছি বাংলাদেশের চারজন স্বনামধন্য এবং সফল নারী উদ্যোক্তার গল্প নিয়ে। তারা শত বাঁধাকে জয় করে আজ নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে হাজারো নারী উদ্যোক্তার প্রেরণা স্বরুপ কাজ করছেন প্রতিনিয়ত।

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে তিনি এসেছেন বাংলাদেশের টেক ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়ে একজন নারী হিসেবে শুরু করেছেন নিজের স্বাধীন ব্যবসা। 2018 সালে এসেও দেশের টেক জগতে যখন খুব একটা ‘নারী পদচারণা’ চোখে পড়ে না, তখন তসলিমা মিজির কথা অবশ্যই বলতে হয়।স্বাধীন নারী উদ্যোক্তা তসলিমা মিজি প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান টেকম্যানিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা এবং চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (CEO)। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি হার্ডওয়্যার, হার্ডওয়্যার বিষয়ক বিভিন্ন সেবা এবং নেটওয়ার্কিং বিষয়ক ব্যবসার সাথে জড়িত। এটি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির একটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান।

একজন নারীর পক্ষে 2018 সালের দিকে হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার খাতে ব্যাবসা শুরু করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। ছিল প্রতিযোগিতা, নারী হিসেবে একটা খাতে প্রথম কাজ শুরু করবার প্রতিকূলতা। বিশেষ করে সাংবাদিকতার জগত থেকে উঠে আসা একজন মহিলা খুব একটা আন্তরিক পরিবেশ পাননি শুরুর সময়টাতে। কিন্তু অদম্য সাহসী মিজি থেমে থাকেননি কখনোই। নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য সুন্দর জায়গা নির্বাচন করে কাজ শুরু করেন তিনি। সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে গড়ে তোলেন তার নিজের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, যা আজকে বাংলাদেশের কম্পিউটার ব্যবসায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে বেশ ভালভাবেই।

তিনি বিশ্বখ্যাত সংস্থা ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন দেড় বছরের বেশি সময় ধরে। পরবর্তীতে একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে ডিক্যাস্টালিয়া (DCastalia) নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে আছেন শুরু থেকেই। দেখাশোনা করছেন প্রতিষ্ঠানটির ‘যোগাযোগ এবং ব্যবসা উন্নয়ন’ বিভাগ। কথা বলছি দেশের স্বনামধন্য নারী উদ্যোক্তা সাবিলা ইনুন সম্পর্কে। কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করা সাবিলা কাজ করেছেন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানেই। তথ্য প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তার কর্মযজ্ঞ। বিজনেস ইন্টেলিজেন্স হিসেবে কাজ করেছেন গ্রামীণফোনে, কাজ করেছেন সেল বাজারে, ডি নেটে, তিনি কাজ করেছেন সিস্টেম সাপোর্ট প্রকৌশলী হিসেবে।

অতঃপর 2012 সালে নাইকি ফাউন্ডেশনের গার্ল ইফেক্ট প্রজেক্টের ডিজাইন ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে যোগ দেন। এই প্রজেক্টের অধীনে তিনি ব্র্যাক এবং পরবর্তীতে ফ্রগ ডিজাইন নামের নামকরা আমেরিকান প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন। এছাড়াও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইউএনডিপির এসআইসিটি প্রজেক্টে কাজ করেছেন একজন ট্রেইনার ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে।বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে একজন নারী হিসেবে তিনিও সম্মুখীন হয়েছেন নানা প্রতিবন্ধকতার। কিন্তু কখনো থেমে যাননি তিনি। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাবিলা উনুন বাংলাদেশের নারীদের জন্য বিশেষ করে তরুণী নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা স্বরুপ। প্রবল ইচ্ছা এবং যোগ্যতা থাকলে কোনো বাঁধা যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তার অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন সাবিলা ইনুন।

নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার আগে তিনি কাজ করছেন দেশি-বিদেশি নানা যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে। অভিজ্ঞতার ঝুলি করেছেন সমৃদ্ধ, শিখেছেন অনেক কিছুই। শেষে নিজেই আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে গড়ে তোলেন টিম ইঞ্জিন নামের প্রতিষ্ঠান, যার ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি নিজেই। এবার সামিরা জুবেরি হিমিকা’র কথা বলছি। দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন ইউএনডিপিতে। পরবর্তীতে কাজ করেন বিবিসি ওয়াল্ড সার্ভিস, বাংলাদেশের ডেপুটি প্রধান হিসেবে। এরপরে কাজ করেন জিপি হাউজ আর্ট হাব নামের এক প্রজেক্টে। এটি ছিল কোনো বেসরকারি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে পরিচালিত প্রথম উদ্যোগ।

প্রায় পাঁচ-ছয়বছর এভাবে কাজ করে তিনি নিজেই একদিন উদ্যোগী শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠানের। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘টিম ইঞ্জিন’ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা নীতি নির্ধারণী বিষয়ে কাজ করছে।একজন মহিলা হিসেবে টেলিকম সেক্টরে কাজ শুরু করা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু হিমিকার নানা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাকে সাহায্য করেছে এক্ষেত্রে। নিজের প্রতিষ্ঠান বাদেও তিনি বেসিসের একজন এক্সিকিউটিভ কমিটি সদস্য। বাংলাদেশে প্রযুক্তি স্টার্ট-আপ ক্ষেত্রে তিনি এখন এক অতি পরিচিত নাম। বিভিন্ন কম্যুনিটি ইভেন্টে প্রায়ই দেখতে পাই আমরা।

তিনি ছিলেন একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মহিলা জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করবেন। হঠাৎ করেই একদিন আইডিয়া এলো, মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং নানা রকম সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি অনলাইন ভিত্তিক কোনো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে পারেন। চাকরি ছেড়ে দিলেন, প্রতিষ্ঠা করলেন অনলাইনভিত্তিক ওয়েবসাইট– মায়া। আইভি হক রাসেলের কথা বলছি, যিনি এখন ‘মায়া আপা’ নামেই বেশি পরিচিত। আইভি হক তার নানা উদ্ভাবনী ধারণা এবং ব্যবসাকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার জন্য সুপরিচিত। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্স এবং অর্থনীতির উপরে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। অনেক আগে থেকেই মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার এক অনবদ্য প্রচেষ্টা কাজ করতো তার মধ্যে।

মূলত এ কারণেই পড়াশোনার জায়গা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন কিছু করার চিন্তা করেন, যা আগে কেউ কখনো করেনি। সেই চিন্তা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অনলাইন প্লাটফর্ম মায়ার, যা মূলত কাজ করে নারীদের নিয়েই। নারীদের জন্য দরকারি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মায়ার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে নারীদের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোর অবাধে যেন পৌঁছে যায়, এই ব্রত নিয়েই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আইভি হক রাসেলের প্রতিষ্ঠান মায়া।তার আজকের এই অবস্থানে আসাটা কখনো সহজ হয়নি, এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তিনি শুরুর সময়টাতে কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সাহায্যই পাননি। কিন্তু তিনি যে থেমে থাকার পাত্রী নন। কাজ চালিয়ে গিয়েছেন নানা বাঁধাকে উপেক্ষা করেই। আজ তার প্রতিষ্ঠান দেশের মহিলাদের কাছে তাদের দরকারি সব তথ্য এবং সেবা পৌঁছে দিতে কার্যকরী অবদান রাখছে। হাজারো নতুন তরুণী উদ্যোক্তার কাছে তিনি আজ এক অনুপ্রেরণার নাম।

আজ আমাদের দেশের নারী রা কিন্তু পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে নেই আমাদের সরকার ব্যবস্থা‌ও। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের দেশের সরকার‌ও। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় সরকারের সাফল্যজনক কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াস কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত ধানমন্ডিস্থ রাপা প্লাজার চতুর্থও পঞ্চম তলায় স্থাপিত ‘জয়িতা’ বিপণন কেন্দ্র । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত 16-11-2011 তারিখ হোটেল রূপসী বাংলা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নারী উদ্যোক্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জয়িতার কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন এবং জয়িতার লগো উন্মোচন করেন।

যাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিপণন এবং বাজারজাতকরণ। এতে করে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে গতি সঞ্চারিত হবে; নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে; নারী ও পুরুষের বৈষম্য হ্রাস পাবে। সর্বোপরি নারীর ক্ষমতায়ন এবং পর্যায়ক্রমে দেশের দারিদ্র বিমোচন।

খুব ঘটা করে প্রতিবছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর 19 নভেম্বর দিবসটি পালিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হয় এ দিবস। তবে আমাদের নারী রা যেনো এমন ভাবে নিজেদের গড়ে তোলে যে তাদের জন্য প্রতিটা দিন‌ ই ঘটা করে পালন করা হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের চলার পথে বাধা আসবেই। একজন নারীকে ঘরের বাইরে কাজ করতে হলে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।

প্রথমেই বাধা আসে পরিবার থেকে। এরপর সমাজ আর রাষ্ট্র তো আছেই। কিন্তু যারা সেই বাধা পেরিয়ে এগিয়ে আসবে তারাই তো সফল হবে, নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হবে। ঘরে ঘরে যেনো নারী উদ্যোক্তা গড়ে ওঠে, যেনো হেরে না যায়একটি নারী, ভেঙ্গে না যায় একটিও স্বপ্ন।

লিখেছেন: সেতু সাহা

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।